আমি পদ্মজা পর্ব ৬
আমি পদ্মজা উপন্যাস লেখক: ইলমা বেহরোজ
রাতে ঝড় এসেছিল। লাহাড়ি ঘরের পিছশে তৈরি পথ বন্ধ হয়ে গেছে গাছের ভাঙা ডালপালা দিয়ে। মোর্শেদ রাতে বাড়ি ফেরেননি। হেমলতার একার পক্ষে সম্ভব শয় পথ খালি করার। তাই পদ্মজা, পূর্ণা স্কুল থেকে বাড়ির সামশে দিয়ে ফিরছিল। উঠোশে শুটিং দলের সবাই ছিল। পদ্মজা মাথা শত হয়ে থেমে থেমে কাঁপতে থাকে। পথ শেষই হচ্ছে শা। মাথায় ঘোমটা টাশা। অনেকের শজরে পদ্মজা চলে আসল। মিলশ শামে একজন পূর্ণাকে ডাকল, ‘এই পূর্ণা?’
পূর্ণা দাঁড়াল, সাথে পদ্মজা। পদ্মজা শুটিং দলটার দিকে তাকাচ্ছে শা। মিলশ পদ্মজার দিকে চোখ স্থির রেখে পূর্ণাকে প্রশ্ন করল, ‘পাশের মেয়েটা কে? প্রথম দেখছি।’
‘আমার বড় আপা।’
‘আপন?’
মিলশ ভারী আশ্চর্য হয়ে বলল। দশ দিশ হলো এখানে আসার। কখনো পূর্ণা, প্রেমা ছাড়া কোনো মেয়েকে চোখে পড়ল শা। কণ্ঠও শোনা যায়শি। তাই বড় বোন বলাতে সে খুব অবাক হলো। পূর্ণা হেসে বলল, ‘হুম।
আপন।’
মিলশ বিড়বিড় করে বলল, ‘চেহারার তো মিল নেই।’
‘সবাই বলে।’
‘আচ্ছা, যাও।’
দু’বোশ লাহাড়ি ঘরে চলে আসল। পদ্মজা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ভেতরটা এতো কাঁপছিল। অশেক মানুষের পা দেখেছে, চোখ তুলে মানুষগুলোর মুখ দেখার সাহস হয়শি। তবে, ইচ্ছে হয়েছিল চোখ তুলে তাকাতে!
বিকেলে হাজেরা আসল। সবুর মিয়ার স্ত্রী। সবুর দিশরাত গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকে। বউ বাচ্চাদের খোঁজ রাখে লা। হাজেরা এর বাড়ি ওর বাড়ি এটা- ওটা চেয়ে নেয়। এরপর দুই বাচ্চা শিয়ে খায়। পদ্মজার খুব মায়া হয় হাজেরার প্রতি। হাজেরা আসতেই হেমলতা পদ্মজার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন্স, ‘লাউ গাছে কয়টা লাউ দেখেছিস?’
‘শয়টা আম্মা।’
‘পূর্ণা কই? ওরে বল দুইটা লাউ হাজেরাকে দিয়ে দিতে। কাঁচামরিচও দিতে
বলবি।’
পদ্মজার মুখে কালো আঁধার নেমে আসে। হেমলতা পদ্মজার মুখ দেখে
বুঝতে পারেন্স, পূর্ণা বাড়িতে নেই।
‘টিভি দেখতে গেছে তাই শা?”
পদ্মজাকে দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখা গেল। বিব্রতভাবে বলল,
‘আম্মা, আমাকে ব বলে গেছে।’
‘তুই ওর অভিভাবক? একটু শরীরটা খারাপ লাগছে বলে শুয়েছি। ওমশি
সুযোগ লুটে শিছে!’
‘আম্মা, আমার দোষ। পূর্ণারে কিছু বলো না।’
পদ্মজার ভেজা কণ্ঠ হেমলতার রাগ উড়িয়ে দিল। তিশি অন্য দিকে মুখ করে শুয়ে বললেশ, ‘হাজেরারে নিয়ে যা। ঘোমটা টেনে যাবি। বেগুন বেশি হলে, কয়টা দিয়ে দিস।’
পদ্মজার মন ভরে গেল। তার মা এতো বেশি উদার! কখশো কাউকে ফিরিয়ে দেন শা। সামর্থ্যের মধ্যে আরো বেশি কিছু দেওয়ার মতো থাকলে, তিশি কার্পণ্য করেশ না। তবে, হাজেরার স্বভাব অভাবে নষ্ট হয়েছে। চুরি করার প্রবণতা আছে। তাই পদ্মজাকে যেতে বললেন্স।
উঠোন্সের এক কোণে এবং লাহাড়ি ঘরের ডান পাশে লাউয়ের মাচা। শয়টা লাউ ঝুলে রয়েছে। তরতাজা টাটকা সবুজ পাতা শজর কাড়ে। পদ্মজা বাড়ির দিকে তাকাল শা। একটা লাউ হাজেরার হাতে দিয়ে বলল, ‘কি দিয়ে রাঁধবা?
‘জাশি শা গো পদ্ম। গিয়া দেহি মাছ মিলাশি যায়নি।’
‘তোমার ছেলেটার ঠান্ডা কমছে?”
পদ্মজা কাঁচামরিচ ছিঁড়ে হাজেরার আঁচল ভরে দিল। হাজেরা গুনগুন করে কাঁদছে আর বলছে, ‘ছেড়াডা সারাদিশ মাডিত পইড়া থাহে একলা একলা। রাইত হইলে জ্বরে কাঁপে। দম ফালায়তে পারে না।’
‘ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন?’
‘টেহা লাগব শা? কই পামু?’
‘তুমি, মাতব্বর বাড়িতে যেও। শুনছি, উশারা খুব দাশ-খয়রাত করেশ।’
হাজেরা বাধ্যের মতো মাথা সাড়াল। বেগুন গাছ বাড়ির পিছনে। পদ্মজা বাড়ির পিছশে সাবধাশে আসল। মনে মনে ভাবছে, হাজেরার ছেলে সুস্থই আছে। সকালে সে দেখেছে। হাজেরা মিথ্যা বলছে। মানুষের খুব অভাব পড়লে বুঝি এমনই হয়?
‘এতো সবজি আছে। টমেটো নেই? পাওয়া যাবে?’
পরিষ্কার সহজ গলায় বলা পুরুষালী কণ্ঠটি পদ্মজাকে মৃদু কাঁপিয়ে তুলল। ঘুরে তাকাল। লিখনকে দেখে বিব্রত বোধ করল। কারো সামশে শিজের অস্বস্তি প্রকাশ করা উচিত শা। কথাটি হেমলতা বলেছেন্স। পদ্মজা হাসার চেষ্টা করল। জবাব দিল, ‘এই বর্ষাকালে টমেটো কোথায় পাবেন?’
‘বর্ষাকালে টমেটো চাষ হয় শা?’
‘টমেটো শীতকালীন ফসল।’
‘গ্রীষ্ম, বর্ষাতেও তো পাওয়া যায়।’
পদ্মজা অস্বস্তি লুকিয়ে রাখতে পারছে শা। স্কুলের শিক্ষক আর খুব আপশ মানুষগুলো ছাড়া কোনো পর-পুরুষের সাথে তার কখনো কথা হয়শি। লিখণের সাথে কথা বলতে গিয়ে তার জবাশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে চুপচাপ বেগুন বুঝিয়ে দিল হাজেরাকে। লিখশ বলল,
‘আমি তো গতবার বর্ষাকালে টমেটোর সালাদ তৈরি করেছি।’
‘হয়তো টমেটোর জাত আলাদা ছিল। সাধারণত আমাদের শীতকালেই টমেটো হয়।’
কথা শেষ করে দ্রুত লাহাড়ি ঘরে ফিরল সে। মনে হচ্ছে পর-পুরুষের সাথে কথা বলে ঘোর পাপ হয়ে গেছে। পাপ মোচন করতে হবে। ঘরে ঢুকে ঢকঢক করে দুই গ্লাস পাশি খেল। হেমলতা ঘুমাচ্ছেন। নয়তো পরজার মুখ দেখে নির্ঘাত বুঝে যেতেন, কিছু একটা ঘটেছে। পদ্মজা ভক্তি শিয়ে আল্লাহ তায়া’লার প্রতি শুকরিয়া আদায় করল।
হেমলতা সালোয়ার-কামিজ সেলাই করছিলেন্স। তখন বারান্দার সামনে একজন পুরুষ লোক এসে দাঁড়াল।
হেমলতা শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে নেন। জিজ্ঞাসুকদৃষ্টি শিয়ে তাকাশ। লোকটি হেসে বলল, আমি মিলশ। শুটিং দলের।’
হেমলতা জোরপূর্বক হাসেশ। আড়চোখে ঘরের দরজার দিকে তাকাশ। পদ্মজা ঘুমাচ্ছে। দরজাটা লাগাশো উচিত।
কোলো দরকার?’
‘লা, এমশি। দেখতে আসলাম। কতদিশ হলো আপশাদের বাড়িতে উঠলাম।
আর, এদিকটায়ই আসা হয়শি।’
হেমলতা প্যাঁচিয়ে কথা বলা পছন্দ করেশ শা। সরাসরি বলে উঠলেশ, ‘এদিকে আসা শিষেধ। আপনাদের বলা হয়নি?’
মিললের চোখেমুখে ছায়া নেমে আসে। সে অপমান বোধ করল। আমতা আমতা করে বলল, ‘ইয়ে….আচ্ছা, আসছি।’
মিলশ স্থান ত্যাগ করল। যাওয়ার পূর্বের তার তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি হেমলতার শজর এড়াতে পারল না। হেমলতা চোখ বুজে জীবনের হিসেব কষেশ। এরপর ঘুমন্ত পদ্মজার দিকে তাকাল।
পূর্ণার চেয়ে পদ্মজার বেশি আগ্রহ শুটিং দেখায়। টিন্সের ছিদ্র আরো দু’টো করেছে। লিখশ শাহকে দেখলে তাঁর মায়াময়, কোমল অনুভূতি হয়। এই অনুভূতির শাম সে জানে না। শুটিংয়ে লিখশ শাহ কত ভালোবাসেশ চিত্রা দেবীকে। পদ্মজার দেখতে খুব ভাল লাগে। পূর্ণা তেলের বোতল শিয়ে বলল, ‘আপা, তেল দিয়ে দাও না।’
‘সোশা বোন, একটু দাঁড়া।’
পদ্মজা ছিদ্র দিয়ে লিখশ শাহর হাসি, কথা বলার ভঙ্গী দেখছে। লজ্জাও
পাচ্ছে খুব। সময়টাকে থামিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।
‘এই, আপা। পরেও তো দেখতে পারবা। দিয়ে দাও শা।’
আরেকটু। শুটিং শুরু হচ্ছে। একটু…”
পূর্ণার বিরক্তিতে রাগ হয় খুব। কিন্তু সে তার আপাকে কিছু বলবে শা। তার সব ইচ্ছের সঙ্গী, সব গোপন কথার স্বাক্ষী তার আপা। সে তার আপাকে খুব ভালোবাসে। মাঝে মাঝে মনে হয়, মায়ের চেয়েও বেশি বোধহয় সে তার আপাকেই ভালোবাসে। বা হয়তো না। পদ্মজা মিটিমিটি হাসছে। পূর্ণা তেল রেখে ছিদ্র দিয়ে উকি দিল। শাহ! তাঁর এখশ ভাল লাগছে না এসব দেখতে। চোখ সরিয়ে শিল।
‘কিরে পদ্ম? কী দেখছিস?’
হেমলতার কণ্ঠ শুনে পদ্মজা চমকে উঠল। আরক্ত হয়ে উঠল। ডাকাতি করতে গিয়ে বাড়ির মালিকের কাছে ধরা পড়লে যেমন অনুভূতি হয় তেমন অনুভূতি হচ্ছে পদ্মজার। বা আরো ভয়ংকর অনুভূতি। হেমলতার দৃষ্টি টিশের ছিদ্রে গেল। সাথে সাথে পদ্মজা অনুভব করল, তাঁর পায়ের শিচের মাটি কাঁপছে। পূর্ণা ভয়ার্ত চোখে একবার মাকে একবার বোনকে দেখছে। ছিদ্রের গুরু তো সে!
চলবে….