আমি পদ্মজা পর্ব ১৫
আমি পদ্মজা উপন্যাস লেখক: ইলমা বেহরোজ
ভোর বেলার সূর্য উদয়ের সময় পরিবেশে মৃদু সূর্যালোক ছড়িয়ে পড়ল। ট্রেনের জানালা দিয়ে সূর্যের আগুনরঙা আলো পদ্মজার মুখশ্রী ছুঁয়ে দিল। ফজরের নামায পড়ে ট্রেনে উঠেছে তারা। গন্তব্য অলন্দপুর। পদ্মজার মেট্রিক শেষ হলো আজ তিন দিন। হেমলতার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজল পদ্মজা। পুরো দেড় মাস পর পূর্ণা, প্রেমা, প্রান্তর দেখা পাবে। খুশিতে আত্মহারা সে। মাঝে একটু জিরিয়ে ফের চলছে ট্রেন। হেমলতা জানালার বাইরে তাকিয়ে আকাশ দেখছেন। কারণে, অকারণে তিনি এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। শুষ্ক চক্ষুদ্বয় যখন তখন সজল হয়ে উঠে। কিছুতেই বারণ মানে না। নীল আকাশের বুকে যেন সেদিন রাতের স্মৃতি আকার নিয়ে ভেসে উঠল। ছেলেটার বয়স তেইশ-চব্বিশ বছর হবে। অবাক চোখে তাকিয়েছিল। দেখতে বেশ ভাল। হেমলতা পদ্মজাকে আড়াল করে কঠিন স্বরে প্রশ্ন করেন,
‘কে তুমি?’
ছেলেটি হেমলতার কথার ধরনে বিব্রতবোধ করল। ইতস্তত করে বলল, ‘মুহিব, মুহিব হোসেন।’
হেমলতার টনক নড়ল। তিনি সাবধানে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বারেক হোসেন তোমার বাবা?’
মুহিব ভদ্রতা সহিত বলল, ‘জ্বি।’
হেমলতা কী যেন বলতে চেয়েছিলেন, বলতে পারলেন না। তার আগে মুহিব বলল, ‘বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আমি আসছি।’ এরপরই হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল। সেদিন আর রাত জাগা হলো না। ছাদ থেকে নেমে গেল তারা। গোপন বৈঠকে একবার বাঁধা পড়লে আর মন সায় দেয় না আলোচনা চালিয়ে যেতে। অনুভূতি গুলো ভোতা হয়ে যায়।
এরপরদিন জানা গেল, মুহিব তার পিতার সাথে রাগ করে ঢাকা ছেড়ে চাচার বাড়ি উঠেছে। এখনকার ছেলে-মেয়েদের ক্ষমতা খুব। তারা খুব সহজ কারণে মা-বাবার সাথে রাগ করে দূরে সরে যেতে পারে। হেমলতা অবজ্ঞায় কপাল কুঞ্চিত করতে সঙ্কোচবোধ করলেন না। পরে অবশ্য বুঝেছেন, মুহিব খুবই ভাল ছেলে। নম্র, ভদ্র, জ্ঞানী। মেধাবী ছাত্র। বিএ পড়ছে। সবচেয়ে ভাল গুণ হলো, মুহিবের নজর সৎ। হেমলতা চোখের দৃষ্টি চিনতে ভুল করেন না। ঠিক সতেরো দিন পর বারেক হোসেন ছেলেকে নিতে আসেন। যেদিন আসেন এরপরদিন রাতে হেমলতাকে প্রস্তাব দেন। মুহিবের বউ হিসেবে পদ্মজাকে নিতে চান। হেমলতা অবাক হোন। মুহিব মনে মনে পদ্মজার উপর দূর্বল অথচ বোঝা গেল না। নিঃসন্দেহে মুহিব পাত্র হিসেবে উপযুক্ত।
মুহিবের বড় দুই ভাই মুমিন, রাজীব। দুজনই চাকরিজীবী। মুমিন বিয়ে করে বউকে ডাক্তারি পড়াচ্ছে। সমর্থনে আছে পুরো পরিবার। অতএব বোঝা গেল, পরিবারের প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্ক, ভাবনা উচ্চ মানের। বারেক হোসেন বিয়ের প্রস্তাবের সাথে এটিও বলেছেন, ‘আমার মেয়ে নেই। ছেলের বউরাই আমার মেয়ে। আপনার মেয়ের যতটুকু ইচ্ছে পড়বে। কোনো বাঁধা নেই।’
হেমলতা প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন না। তিনি আনন্দ সহিতে জবাব
দিলেন, ‘পদ্মজা আইএ শেষ করুক। এরপরই না হয়।’
বারেক হোসেন হেসে বলেন, ‘তাহলে এটাই কথা রইল।’
স্মৃতির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন হেমলতা। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। গলাটা কাঁপছে। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে পানি পান করলেন।
প্রেমা, প্রান্ত বাড়ির বাইরে সড়কে পায়চারি করছে। পূর্ণা গেইটের আড়াল থেকে বার বার উঁকি দিয়ে দূর রাস্তা দেখছে। মোর্শেদ হেমলতা আর পদ্মজাকে আনতে গঞ্জে সেই কখন গেল, এখনো আসছে না। পুরো দেড় মাস পর মা-বোনের সাক্ষাৎ পাবে তারা। হৃদপিণ্ড দ্রুতগতিতে চলছে। মিনিট পাঁচেক পর কাঁচা সড়কের মোড়ে মোর্শেদের পাশে কালো বোরখা পরা দুজন মানুষকে দেখতে পেল তারা। পূর্ণা লাজলজ্জা ভুলে আগে আগে ছুটে গেল। পিছনে প্রান্ত এবং প্রেমা। ছুটে এসে মা-বোনকে একসাথে জড়িয়ে ধরে প্রবল কণ্ঠে কেঁদে উঠল পূর্ণা। হেমলতা পূর্ণাকে ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। মাঝে মাঝে একটু বাড়াবাড়ি করা দোষের নয়। পদ্মজার চোখ বেয়েও টপটপ করে জল পড়ছে। প্রায় প্রতিটা রাত সে ভাই বোনদের মনে করেছে। বিশেষ করে পূর্ণাকে বেশি মনে পড়েছে। মনে হচ্ছে কত শত বছর পর দেখা হলো। আর পূর্ণা বাড়ির আনাচে কানাচে পদ্মজার শূন্যতা অনুভব করেছে। সে অশ্রুসিক্ত চোখ মেলে তাকাল পদ্মজার দিকে। এরপর আবার জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপা, আমার এতো আনন্দ হচ্ছে। এতো আনন্দ কখনো হয় নাই।’
পদ্মজার কোমল হৃদয় পূর্ণার ভালবাসা দেখে বিমোহিত হয়ে উঠল। সে স্নেহার্ধ কণ্ঠে বলল, ‘আমার সোনা বোন। আর কাঁদিস না।’
পূর্ণা চোখের জল দ্রুত মুছল। প্রফুল্লচিত্তে বলল,’ আপা, আমি তোমার পছন্দের চিংড়ি মাছ দিয়ে লতা রেঁধেছি।’
পদ্মজা অবাক চোখে তাকাল। হেমলতা প্রশান্তিদায়ক সুখ অনুভব করলেন।
এক বোনের প্রতি আরেক বোনের নিঃস্বার্থ ভালবাসা দেখে। পদ্মজা বাকহারা হয়ে পূর্ণার দুই গালে চুমো দিল। মোর্শেদ দৃশ্যটি মুগ্ধ হয়ে দেখেন। এরপর তাড়া দেন, ‘দেহো মাইয়াডির কারবার। মানুষ আইতাছে। আর হেরা রাস্তায় কান্দাকাটি লাগাইছে। হাঁট সবাই, হাঁট।’
খাওয়া দাওয়া শেষ করে চার ভাই বোন ঘাটে গিয়ে বসল। দেড় মাসে কী কী হলো, না হলো সব পূর্ণা বলছে। প্রেমা পূর্ণার নামে বিচার দিল। প্রান্ত প্রেমার নামে বিচার দিল। প্রান্ত কেন বিচার দিল, তা নিয়ে প্রেমা বাকবিতন্ডা লাগিয়ে দিল। সে কী কান্ড! দুজন তুমুল ঝগড়া লেগে গেল। এরপর দুজনই বিচার নিয়ে গেল হেমলতার কাছে। তখন পদ্মজা শুষ্ককণ্ঠে পূর্ণাকে বলল, ‘জানিস পূর্ণা, আম্মা আমার বিয়ে ঠিক করছে।’
পূর্ণা ভীষণ চমকাল। চমকিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘কবে? কার সাথে?’
‘যে বাড়িতে ছিলাম ওই বাড়ির ছেলের সাথে। বিএ পড়ছে। আমার আইএ শেষ হলে বিয়ের তারিখ পড়বে।’
‘আপা, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আম্মার না ইচ্ছে তোমাকে অনেক পড়াবে। তোমার চাকরি হবে।’
পদ্মজা চুপ থাকল ক্ষণকাল। এরপর বলল, ‘আম্মার কী যেন হয়েছে। পাল্টে গেছেন।’
‘কী রকম?’ ‘আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বেশিরভাগ কথা এড়িয়ে যান। আমার ভবিষ্যত নিয়ে আগের মতো আগ্রহ দেখান না। আমি কথা তুললে এড়িয়ে যান। গল্প করেন না। মানে, আগের মতো নেই।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে পদ্মজার গলা কিঞ্চিৎ কাঁপল।
‘সেকী!’
‘সত্যি।’
‘কিছু হয়েছে ওখানে?’
‘না। আমি যতটুকু জানি তেমন কিছুই হয়নি।’
পূর্ণা সীমাহীন আশ্চর্য হয়ে চিন্তায় ডুবল। পদ্মজা শূন্যে তাকিয়ে রইল। লিখন শাহ নামে মানুষটার কথা মনে পড়ছে। তিনি যখন শুনবেন এই খবর, সহ্য করতে পারবেন? সত্যি ভালবেসে থাকলে সহ্য করতে কষ্ট হবে নিশ্চয়ই।
পূর্ণা দ্বিধাভরে প্রশ্ন করল, ‘আপা, লিখন ভাইয়ের কী হবে?’
পদ্মজা ক্লান্ত ভঙ্গিতে তাকাল। বলল, ‘আমি তাকে বলেই দিয়েছি, আম্মা যা বলবেন তাই হবে।’
পূর্ণার বড্ড মন খারাপ হয়ে গেল। তার আপার মতো সুন্দরীকে শুধুমাত্র লিখন শাহর পাশেই মানায়। কত স্বপ্ন দেখল সে, লিখন শাহ এবং পদ্মজাকে নিয়ে। সব স্বপ্নে গুড়ো বালি। সে কাতর কণ্ঠে বলল, ‘লিখন ভাইয়ের সাথে তোর বিয়ে না হলে আমি কষ্ট পাব খুব।’
‘আমিতো আম্মার কথার বাইরে যেতে পারব না।’
পূর্ণা গলার স্বর খাদে এনে বলল, ‘যদি লিখন ভাই রাজি করাতে পারে?’
পদ্মজা অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। সেই দৃষ্টি যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে, এ হওয়ার নয়! পূর্ণা কপাল কুঁচকে ফেলল। বিরক্তিতে বলে উঠল, ‘ধ্যাত!’
বাতাসটা গরম গরম ঠেকছে। ক্রমশ মাথা ব্যাথা বেড়ে চলেছে। এতো এতো গাছগাছালি চারিদিকে তবুও এতটুকুও শীতলতা নেই পরিবেশে। হেমলতা আলমারির কাপড় গুছিয়ে বিছানার দিকে তাকালেন। মোর্শেদ এই রোদ ফাটা দুপুরে কখন থেকে ঝিম মেরে বিছানায় বসে আছে। মুখখানা বিমর্ষ, চিন্তিত। হেমলতা প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘কোনো সমস্যা?’
মোর্শেদ তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলেন। হেমলতা তাকিয়ে রইলেন জবাবের আশায়। ক্ষণকাল সময় নিয়ে মোর্শেদ বললেন, ‘বাসন্তী এই বাড়িত আইতে চায় থাকবার জন্যে।’
হেমলতার চোখ দু’টি ক্রোধে জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল। নির্বিকার কণ্ঠে বলেন, ‘তোমার ইচ্ছে হলে নিয়ে এসো। বাড়ি তো তোমার।’
মোর্শেদ চকিত চোখে তাকান। তিনি ভেবেছিলেন হেমলতা রাগারাগি করবে। মোর্শেদের চোখ দু’টির দৃষ্টি তীক্ষ্ণ রূপ নিল। কিড়মিড় করে হেমলতাকে বলেন, ‘আমি তারে চাই না।’
হেমলতা ঠাট্টা করে হাসলেন। বললেন, ‘বিশ বছর সংসার করে এখন তাকে চাও না! আমি হলে মামলা ঠুকতাম।’
মোর্শেদ আহত মন নিয়ে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। চোখ দুটিতে অসহায়ত্ব স্পষ্ট। হেমলতা নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে সরে পড়েন। মোর্শেদ তখন কপট রাগ নিয়ে নিজে নিজে আওড়ান, ‘আমারে ডর দেহায়। মাডারে খুন করতে পারলে জীবনে শান্তি পাইতাম।’
হেমলতা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান। মোর্শেদকে পরখ করে নেন। রাগে ছটফট করছে মোর্শেদ। বাসন্তীর প্রতি তার এতো রাগ কেন? তিনি দু পা এগিয়ে আসেন। বললেন, ‘ভালোবাসার মানুষকে এভাবে গালি দিয়ে ভালোবাসা শব্দটির সম্মান খুইয়ে দিও না।’
‘আমি তারে কোনকালেও ভালোবাসি নাই। বাসলে তোমারে বাসছি।’
হেমলতা ভীষণ অবাক হয়ে, চোখ তুলে তাকান। ভোতা অনুভূতি গুলো মুহূর্তে নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। মোর্শেদ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। দৃষ্টি অস্থির। বিছানা থেকে নেমে, গটগট পায়ে বেরিয়ে যান। হেমলতা মোর্শেদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকেন, ঝাপসা চোখ মেলে। এই মানুষটার থেকে এই একটি শব্দ শোনার জন্য একসময় কত পাগলামি করেছেন তিনি। কত কেঁদেছেন। আকুতি, মিনতি করেছেন। সত্য হোক কিংবা মিথ্যে হেমলতার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। বয়সটা কম হলে আজ তিনি অনেক পাগলামি করতেন, অনেক!
পূর্ণার ভীষণ জ্বর। তাই পূর্ণাকে নানাবাড়ি রেখেই পদ্মজা বাড়ি ফিরল। সাথে এলো হিমেল, প্রান্ত, প্রেমা। বাড়িজুড়ে ছোটাছুটি করে লাউ, শিম, লতা, পুঁইশাক বন্দোবস্ত করল। হিমেল বাজার থেকে মাছ এনে দিল। বাড়িতে শুটকি ছিল। আজ হেমলতা আর মোর্শেদ ফিরবে। তাই এতো আয়োজন। দুই দিন আগে ঢাকা গেলেন তারা। হেমলতার বড় বোন হানির মেজো মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। হানি বলেছেন, হেমলতা না গেলে তিনি বিয়ের তারিখ ফেলবেন না। তাই বাধ্য হয়ে হেমলতা গিয়েছেন। তবে, পদ্মজার খটকা লাগছে শুরু থেকে। তার মা তাকে রেখে পাশের এলাকায় যেতেও আপত্তি করেন। আর আজ দু’দিন ধরে তিনি মাইলের পর মাইল দূরে পদ্মজাকে ছাড়া রয়েছেন। এসব এখন ভাবার সময় নয়। পদ্মজা যত্ন করে কয়েক পদের রান্নার প্রস্তুতি নিল। সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই। পরিবেশ ঠান্ডা, স্তব্ধ। এ যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। প্রান্ত-প্রেমা উঠান জুড়ে মারবেল খেলছে। হিমেল শুধু দেখছে। মাঝে মাঝে প্রবল কণ্ঠে হাসছে। হাত তালি দিচ্ছে। রান্না শেষ হলো বিকেলে। প্রেমা, প্রান্ত, হিমেলকে খাবার বেড়ে দিল পদ্মজা। খাওয়া শেষ হলে বলল, ‘হিমেল মামা, প্রান্ত আর তুমি পূর্ণারে নিয়ে আসো। সন্ধ্যা হয়ে যাবে একটু পর। আম্মা, আব্বাও চলে আসবে।’
হিমেল, প্রান্ত বের হতেই পিছন পিছন ছুটে গেল প্রেমা। পদ্মজা একা হয়ে গেল। রান্নাঘর গুছিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বাতাস বইছে প্রবলবেগে। বাতাসের দাপটে চুল, ওড়না উড়ছে। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। পরিবেশ অন্ধকার হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। মনটা কু গাইতে লাগল। পদ্মজা এক হাত দিয়ে অন্য হাতের তালু চুলকাতে চুলকাতে গেইটের দিকে বারংবার তাকাচ্ছে। যতক্ষণ কেউ না আসবে শান্তি মিলবে না। বিকট শব্দ তুলে কাছে কোথাও বজ্রপাত পড়ল। ভয়ে পদ্মজার আত্মা শুকিয়ে গেল। চারিদিক কেমন অন্ধকার হয়ে এসেছে! ঘোমটা টেনে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। বিকট বজ্রপাত, দমকা হাওয়া, বড় বড় ফোটার বৃষ্টি। সব মিলিয়ে প্রলয়ঙ্কারী ঝড় বইছে যেন। লাহাড়ি ঘরের মাথার উপরে থাকা তাল গাছ অবাধ্য বাতাসের তেজে একবার ডানে আরেকবার বামে ঝুঁকে পড়ছে। পদ্মজার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল ভয়ে। ছুটে গেল নিজের রুমে। বিছানার উপর কাচুমাচু হয়ে বসল। টিনের চালে ধুমধাম শব্দ হচ্ছে। বৃষ্টির বেগ বেড়ে চলেছে। এতসব শব্দ ভেদ করে আরেকটি শব্দ কানে এলো। সদর ঘরে কিছু একটা পড়েছে।
পদ্মজা ভয় পেয়ে গেল। পরপরই খুশিতে আওড়াল, ‘আম্মা আসছে।’
বিছানা থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে সদর ঘরে আসল। সদর ঘর অন্ধকারে তলিয়ে আছে। জানালা দিয়ে আসা ইষৎ আলোয় পদ্মজা টের পেল একজন পুরুষের অবয়ব। সাথে সাথে সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে পড়ল। পা’দুটি স্তব্ধ হয়ে গেল। পদ্মজা কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘কে আপনি? খালি বাড়িতে কেন ঢুকেছেন?’
কোনো জবাব আসল না। পদ্মজা অনুরোধ করে ভেজা কণ্ঠে বলল,’ বলুন না কে আপনি?’
একটি ম্যাচের কাঠি জ্বলে উঠল। সেই আলোয় দু’টি গভীর কালো চোখ বিভ্রম নিয়ে তাকিয়ে রইল পদ্মজার দিকে। শীতল, স্পষ্ট কণ্ঠে চোখের মালিক বলল, ‘আমির হাওলাদার।’
পদ্মজা পুরুষালী কণ্ঠটি শুনে আরো ভড়কে গেল। রগে, রগে বরফের ন্যায় ঠান্ডা সুক্ষ্ম কিছু একটা দৌড়ে গেল। এক হাত দরজায় রেখে, পদ্মজা আকুতি করে বলল, ‘আপনি চলে যান। কেন এসেছেন?’
উত্তরের আশায় না থেকে পদ্মজা দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল। রুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিল। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়েছে। কাজ করছে না। লোকটা যদি সম্মানে আঘাত করে বা গ্রামের মানুষ যদি দেখে ফেলে খালি বাড়িতে অচেনা পুরুষের সাথে, কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। সে আর ভাবতে পারছে না। দরজায় করাঘাত শুনে পদ্মজা রুমের সব আসবাবপত্র ঠেলেঠুলে দরজার কাছে নিয়ে আসল। এরপর মাটিতে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। দু’হাত মাথায় রেখে আর্তনাদ করে ডাকল, ‘আম্মা, কই তুমি? আমি খুব একা আম্মা। আম্মা…।
আমি পদ্মজা ১৬ নং পর্বটি পড়তে পারেন।