আমি পদ্মজা পর্ব ৭
আমি পদ্মজা উপন্যাস লেখক: ইলমা বেহরোজ
হেমলতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে দুই মেয়েকে দেখেন। তিশটা ছিদ্র দেখেন। এরপর দৃষ্টি শীতল করে বললেশ, ‘শুটিং দেখছিলি?”
পদ্মজা বাধ্যের মতো মাথা ঝাঁকাল। হেমলতার রাগ হলো শা। তিশি চৌকিতে বসে প্রশ্ন ছুঁড়লেন্স, ‘ছিদ্রের বুদ্ধি পূর্ণার?’
প্রশ্নটা শুনে পূর্ণার গলা শুকিয়ে আসল। এক ফোঁটা পাশি দরকার। শয়তো দম বেরিয়ে যাবে। পদ্মজা চকিতে চোখ তুলে তাকাল। অসহায় কণ্ঠে বলল, ‘আম্মা, আর হবে শা। পূর্ণাকে কিছু বলো শা। ওর দোষ শাই, আমি…” হেমলতা পদ্মজাকে কথা শেষ করতে দিলেশ শা। প্রেমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা
করলেশ, ‘প্রেমা, তোর আব্বা কই?’
‘উঠালে।’
‘গিয়ে বল, আমি ডাকছি।’
প্রেমা ছুটে গেল। আবার ছুটে আসল। হেমলতা বারান্দা পার হয়ে চুলার দিকে এগোলেন্স। তখল মোর্শের আসলেন্স।
‘কি হইছে? ডাক কেরে?!
‘লাহাড়ি ঘরে একটা জাশালা করে দাও। মেয়েদের চৌকির পাশে। কাঠ আছে মুরগির খোপের কাছে।’
‘কী জন্যে?’
‘আমি চাইছি, তাই। শা পারলে বল। অন্য কাউকে ডাকব।’
‘ত্যাড়া কথা কওল ছাড়।’
‘আমার তোমার সাথে ভালো করে কথা বলতে ভালো লাগে না।’
‘লাগব কেরে? তোমার তো আমারে পছন্দ না। তোমার পছন্দ বিলাই চোখা
ব্যাঠা ছেড়ারে।’
‘অহেতুক কথা বল শা। মাসের পর মাস কোথায় থাকো তা আমার অজানা শয়। রোগে ধরলেই লতার কথা মনে পড়ে।’
মোর্শেদ মিশিট খালেক রাগ শিয়ে তাকিয়ে থাকলেশ।
মোর্শেদ ঘন্টাখানেক সময় শিয়ে দুই ফুট উচ্চতার জাশালা করলেন্স। পদ্মজা, পূর্ণা হতবাক। সেই সাথে খুশি। হেমলতা ছোট পর্দা টাশিয়ে দেন। রুম থেকে বাহির দেখা যায়। কিন্তু জাশালার ওপাশে কে আছে বাহির থেকে দেখা যায় না।
সন্ধ্যা মুহূর্তের শুটিং শুরু হয়। পদ্মজা, পূর্ণা, প্রেমা চৌকিতে বসল চিড়া শিয়ে। তাদের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। হেমলতা তা দেখে মৃদু হাসলেশ। বড় মেয়ে দুটো কখনো মুখ ফুটে শখ আহ্লাদের কথা বলে শা। শা বলা সত্ত্বেও অনেকবার দুই বোনের ইচ্ছে পূরণ করেছেন তিনি। আর কিছু ইচ্ছে বুঝতে পারলেও পূরণের সামর্থ্য হয়ন্সি হেমলতার।
হেমলতা ঘরের বাইরে যেতেই পূর্ণা বলল, ‘আমাদের মায়ের মতো সেরা মা আর কেউ শা। তাই না আপা?’
‘মায়ের মতো কেউ হয় শা। সবার কাছে সবার মা সেরা। আমাদের মা আমাদের কাছে সেরা। লাবণ্যর মা লাবণ্য আর ওর ভাইদের কাছে সেরা।
মণির মা মশির কাছে সেরা।’
‘ওরা বলছে?”
‘বোকা! এসব বলতে হয় শা।’
‘শা, আমাদের আম্মাই সবচেয়ে ভালো মা। এমন্স মা আর একটাও নেই।’
হেমলতার কাশে প্রতিটি কথা আসে। পূর্ণা সবার অনুভূতি অনুভব করতে জালে না। পদ্মজা জানে।
‘আমাদের আম্মা সত্যি সেরা। আলাদা। ‘পদ্মজা হেসে বলল।
পূর্ণা জাঙ্গালার বাইরে চোখ রেখে প্রশ্ন করল, ‘আপা, চিত্রা দিদিরে কেমন লাগে?’
পদ্মজা চিত্রার দিকে তাকাল। ছাইরঙা শাড়ি পরা। হাতে কালো রঙের ঘড়ি। ফুলহাতা ব্লাউজ। শালীন তবে সর্বাঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া। শাকে সাদা পাথরের শাকফুল। লম্বা চুল বেণি করে রেখেছে। মুখে খুব মায়া। স্নিগ্ধ একটা মুখ। যেন শরৎ-এর শুভ্র এক টুকরো মেঘ। পদ্মজা বলল, ‘আমার দেখা দ্বিতীয় সুন্দর মেয়েমানুষ চিত্রা দিদি।’
পূর্ণা আগ্রহ শিয়ে জানতে চাইল, ‘প্রথম কে?’
পদ্মজা কণ্ঠ খাদে নামিয়ে মোহময় কন্ঠে বলল, ‘আমাদের আম্মা।’
হেমলতার বুক শীতল, স্নিগ্ধ, কোমল অনুভূতিতে ছেয়ে গেল। পদ্মজা এতো সুন্দর করে ‘আমাদের আম্মা’ বলেছে! হেমলতা প্রথম…এই প্রথম শুনলেন, তিশি সুন্দর! ভূবশ মোহিনী রূপসীর মুখে শুনলেন। এই আনন্দ কোথায় রাখবেশ তিশি। কেন ছেলেমানুষী অনুভূতিতে তলিয়ে যাচ্ছেন তিনি! প্রেমা অবাক স্বরে বলল, ‘আম্মা তো কালো। চিত্রা দিদির চেয়ে সুন্দর কীভাবে?’ ‘এভাবে বলছিস কেন প্রেমা? তুই ফর্সা হয়ে গেছিস বলে কালোকে ভালো মলে হয় লা?’
পূর্ণা গমগম করে উঠল। প্রেমা ভয় পেল। পদ্মজা বলল, ‘পূর্ণা, বকছিস কেন? প্রেমা কত ছোট। ও কী সুন্দরের গভীরতা বুঝে? ও খালি চোখে ফর্সা, কালোর তফাৎ দেখে।’
‘সুন্দরের গভীরতা তো আমিও বুঝি শা।’
পূর্ণার কণ্ঠ ভারী নিষ্পাপ শোনাল। পদ্মজা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল হেমলতার উপস্থিতি। এরপর বলল, ‘আম্মার রং কালো। কিন্তু সৌন্দর্যের কমতি নেই। আম্মাকে কখলো এক মণে দেখিস, বুঝবি। আমাদের আম্মার চোখ দুটি গভীর, বড়, বড়। পাতলা, মসৃণ ঠোঁট। আম্মার ঘণ চুলের খোঁপায় এক আকাশ কালো মেঘ। আম্মার শাড়ির কুচির ভাজে আভিজাত্য লুকোনো। আম্মা যখন তীক্ষ্ণ চোখে আমাদের দিকে তাকাশ, তখন মনে হয়, বিরাট বড় রাজত্বের রাশী তাঁর পূর্বপুরুষের ক্ষমতা প্রকাশ করছেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি শিয়ে। এতকিছু থাকা সত্ত্বেও ও কী আম্মা আমাদের দেখা প্রথম সুন্দর মানুষ হতে পারেন্স লা?’
পদ্মজার প্রতিটি কথা পূর্ণার উপর ভীষণ ভাবে প্রভাব ফেলল। প্রেমা চোখ পিটপিট করে কিছু ভাবছে। পূর্ণা বলল, ‘হতে পারে। কাল থেকে আমি আম্মাকে দেখব মন দিয়ে।’
‘আমিও।’ প্রেমা পূর্ণার দলে ঢুকল।
হেমলতার চোখ বেয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। এই কালো রঙের জন্য ছোট থেকে সমাজে তুচ্ছতাচ্ছিল্য হয়ে এসেছেন। কত লুকিয়ে কাঁদা হয়েছে। কত করে চাওয়া হয়েছে, কেউ সুন্দর বলুক। কিন্তু সেই কপাল কখনো হয়শি। আর আজ, এই বয়সে এসে শুনলেন, তিশি কুৎসিত শশ। তার মাঝেও সৌন্দর্য আছে। জন্মদাত্রী মা কালো রঙের জন্য গরম চামচ দিয়ে পোড়া দাগ করেছিলেশ ঘাড়ে। আর গর্ভের সন্তান আজ সেই অনুচিত কাজের জবাব দিল। আল্লাহর সৃষ্টি কেউ অসুন্দর শর। সবার মধ্যেই সৌন্দর্য আছে। যা ধরা পড়ে শুধুমাত্র সুন্দর একজোড়া চোখে।
নিশুতি রাত। চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। হেমলতা চোখ খুলেন্স। হুট করে ঘুমটা ভেঙে গেল। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ইঙ্গিত করছে কোনো ষড়যন্ত্রের। লাহাড়ি ঘরের ডাশ পাশে দু’জোড়া পায়ের আওয়াজ। হেমলতার বুক কেঁপে উঠল। তিশি দ্রুত উঠে বসেশ। দুই চৌকির মাঝের পর্দা সরিয়ে দেখেন পদ্মজার অবস্থান। পদ্মজাকে ঘুমাতে দেখে আটকে যাওয়া নিঃশ্বাস ছাড়েন। পায়ের আওয়াজ একদম পাশে শোনা যাচ্ছে। হেমলতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি শিয়ে ডাশ পাশে তাকাশ। গাঢ় অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবুও তিশি তাকিয়ে আছেন। দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে, অদৃশ্য গোপন শত্রুকে তিশি দেখতে পাচ্ছেন।
‘কে ওখালে?’
হেমলতার ঝাঁঝালো কন্ঠে পায়ের আওয়াজ থেমে গেল। সেকেন্ড কয়েক পর দুই’জোড়া পা যেন ছুটে পালাল।
আমি পদ্মজা ১ নং পর্ব টি পড়তে পারেন।
চলবে…..